পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার: বাংলার প্রাচীন সভ্যতার অনন্য নিদর্শন

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট্ট জনপদ নওগাঁ জেলা, যার বুকে জেগে আছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য—পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি একসময় বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা ও দর্শনের কেন্দ্রস্থল ছিল। আজ এটি UNESCO-র বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমাদের গৌরবের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এই স্থাপনাটি দেখলে মনে হয়, সময় যেন থমকে গেছে। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সভ্যতার চিহ্নগুলো আজও যেন ইতিহাসের পাতা উল্টে দেয়। পর্যটকদের কাছে এটি শুধু একটি ভ্রমণস্থান নয়, বরং ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার এক দরজা।


🏡 সংক্ষিপ্ত পরিচয়

পাহাড়পুরের প্রকৃত নাম সোমপুর মহাবিহার। পাল রাজবংশের মহান রাজা ধর্মপাল (৭৭০–৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) এটি নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এটি পাল বংশের আরেক রাজা দেবপালের অধীনে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে।

এই বিহারটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। “পাহাড়পুর” নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে বলা হয়, প্রাচীন কালে এখানে একটি বিশাল মাটির ঢিবি ছিল, যা পাহাড়ের মতো দেখতে ছিল। সেখান থেকেই এর নাম “পাহাড়পুর”।

বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি সংরক্ষণের দায়িত্বে আছে এবং এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সুন্দর পাহাড়পুর জাদুঘর


🗺️ অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা

পাহাড়পুর বিহারটি নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। রাজশাহী শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার, আর রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার

🚗 কিভাবে যাওয়া যায়

  • ঢাকা থেকে: বাসে নওগাঁ বা বগুড়া হয়ে সরাসরি পাহাড়পুরে যাওয়া যায়। “হানিফ”, “এনা”, “এস.আর” ইত্যাদি পরিবহন ঢাকায় থেকে ছাড়ে।
  • রাজশাহী থেকে: লোকাল বাস বা মাইক্রোবাসে সহজেই যাওয়া সম্ভব।
  • স্থানীয় পরিবহন: নওগাঁ শহর থেকে সিএনজি, অটোরিকশা বা প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়া যায়।

🏨 থাকার জায়গা

পাহাড়পুর এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি অতিথিশালা রয়েছে। নওগাঁ ও জয়পুরহাট শহরেও অনেক ভালো হোটেল আছে। রাতে থাকতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন রেস্ট হাউস অন্যতম।


📜 ইতিহাসের ধারাবাহিকতা

বাংলাদেশের পাল যুগ (অষ্টম–দ্বাদশ শতাব্দী) ছিল বৌদ্ধ ধর্মের স্বর্ণযুগ। এই সময়েই রাজা ধর্মপাল ‘সোমপুর মহাবিহার’ নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন এক জ্ঞানী ও ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ রাজা, যিনি বৌদ্ধ শিক্ষাকে রাজদরবারের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন।

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য তৈরি এই বিশাল বিহার ছিল তখনকার ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম শিক্ষা কেন্দ্র। এখানে বৌদ্ধ দর্শন, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভাষা ও শিল্পকলার শিক্ষা দেওয়া হতো।

কালের বিবর্তনে ১১শ শতকের দিকে সেন রাজবংশের উত্থানের পর এবং মুসলিম শাসনের সূচনার সাথে সাথে বিহারটির পতন ঘটে। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবহেলায় এটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়।

১৯২৩ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কেনেথ দে ব্রিন এখানে খনন কাজ শুরু করেন এবং আবিষ্কার করেন সেই মহান সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ।


🏛️ স্থাপত্য নিদর্শন ও নির্মাণ শৈলী

পাহাড়পুর বিহারের মূল আকৃতি একটি বিশাল বর্গাকার প্রাচীরবেষ্টিত কমপ্লেক্স। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭৫ মিটার ও প্রস্থ ২৭৩ মিটার।

🧱 মূল মন্দির

কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল পিরামিড আকৃতির মন্দির, যার উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার। এটি মোট ২১ স্তর বিশিষ্ট, প্রতিটি স্তরে পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি দ্বারা অলঙ্কৃত।

🏚️ ভিক্ষুকদের কক্ষ

চারপাশে রয়েছে ১৭৭টি ছোট ছোট ঘর, যা ভিক্ষুদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতিটি ঘরে একটি করে জানালা, বেদি ও পাথরের পাটাতন ছিল।

🎨 পোড়ামাটির ফলক

এখানকার পোড়ামাটির ফলকগুলোতে মানুষের জীবনধারা, প্রাণী, গাছ, ফুল, পাখি ও ধর্মীয় দৃশ্য চিত্রিত রয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পকলার এক অনন্য নিদর্শন।

🔎 প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

খননের সময় এখানে পাওয়া গেছে মূর্তি, মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, তাম্রলিপি, গহনা ও মৃৎপাত্র, যা এখন পাহাড়পুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।


🧘‍♂️ বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পাহাড়পুর

প্রাচীন কালে সোমপুর মহাবিহার ছিল এক আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র। চীন, নেপাল, তিব্বত এমনকি ইন্দোনেশিয়া থেকেও ভিক্ষুরা এখানে অধ্যয়ন করতে আসতেন।

এখানে যে ধরনের শিক্ষা দেওয়া হতো, তা ছিল মূলত বৌদ্ধ দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ব্যাকরণ, ও সাহিত্য
এক সময় এটি ছিল ভারতের বিখ্যাত নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহার-এর সমকক্ষ।


🌿 প্রকৃতি ও পরিবেশ

পাহাড়পুরের চারপাশে রয়েছে সবুজ ক্ষেত, পুকুর, বটগাছ, পাখির কূজন ও শান্ত পরিবেশ। বসন্তকালে মাঠজুড়ে সরিষার হলুদ ফুলে এক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে মাটির গন্ধে ও জলে ভেজা ইটের গায়ে পুরনো দিনের ছোঁয়া ফিরে আসে।


🧭 পর্যটনের আকর্ষণ

🎟️ দর্শনীয় স্থান

  • সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ
  • পাহাড়পুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর
  • ভিক্ষুকদের কক্ষ ও পোড়ামাটির ফলক
  • মূল স্তূপ ও কেন্দ্রীয় মন্দির

📸 পর্যটকদের প্রিয় কাজ

– ছবি তোলা, ইতিহাস জানা, স্থানীয়দের সঙ্গে গল্প করা, ও জাদুঘর ঘোরা।
– স্থানীয় মেলা বা পূর্ণিমা উৎসবে অংশগ্রহণ করাও অনেক আকর্ষণীয়।


🎒 ভ্রমণ টিপস

  1. ভ্রমণের সময়: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টা সবচেয়ে উপযুক্ত। আবহাওয়া ঠান্ডা ও মনোরম থাকে।
  2. যা সঙ্গে নেওয়া উচিত: পানি, ছাতা, ক্যামেরা, আরামদায়ক জুতো ও হালকা খাবার।
  3. থাকার পরামর্শ: নওগাঁ বা জয়পুরহাট শহরে ভালো হোটেল আছে। পাহাড়পুরে একদিনের ভ্রমণে থাকাটাও সম্ভব।
  4. স্থানীয় খাবার: নওগাঁর পিঠা, মুরগির ঝোল, দই ও গরুর মাংস বিখ্যাত।
  5. গাইড: স্থানীয় গাইডদের থেকে ইতিহাস শুনে ভ্রমণ করলে অভিজ্ঞতা অনেক সমৃদ্ধ হয়।
  6. নিরাপত্তা: সন্ধ্যার আগেই মূল এলাকা ঘুরে ফেলা ভালো।
  7. পরিবেশ সচেতনতা: প্রত্নস্থানে কোনো আবর্জনা ফেলবেন না; এটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এখানে এসে বোঝা যায়—আমাদের পূর্বপুরুষরা কেবল ধর্মীয় নয়, জ্ঞান, শিল্প ও দর্শনের সাধনাতেও কতটা উন্নত ছিলেন।

আজকের পর্যটকদের দায়িত্ব এই ইতিহাসকে জানতে, ভালোবাসতে ও সংরক্ষণে ভূমিকা রাখা।
যখন সূর্য অস্ত যায়, পাহাড়পুরের ইটের গায়ে আলো-ছায়া খেলে যায়, তখন মনে হয়—এ যেন ইতিহাসের নীরব ফিসফিসানি, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা এক ঐতিহ্যবাহী জাতির উত্তরসূরি।